শিক্ষণ কার্যক্রম ও কলা কৌশল চেংনা উচ্চ বিদ্যালয়

শিক্ষা মানব জীবনের সর্বোচ্চ সম্পদ। একটি জাতির সভ্যতা, সংস্কৃতি, উন্নয়ন ও অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। কিন্তু শিক্ষা শুধু পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু মুখস্থ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সঠিক শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠ শিক্ষণ কার্যক্রম। শিক্ষণ কার্যক্রম বলতে বোঝায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পারস্পরিক যোগাযোগ, শ্রেণিকক্ষের পাঠদান, সহপাঠ কার্যক্রম, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এবং শিক্ষার্থীর মননশীলতা বিকাশের সমস্ত কার্যক্রমকে।

একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল শক্তি হলো তার শিক্ষণ কার্যক্রম। এই কার্যক্রম যত উন্নত ও আধুনিক হবে, ততই শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা অর্জন করতে পারবে এবং ভবিষ্যতে যোগ্য নাগরিক হয়ে সমাজে অবদান রাখতে সক্ষম হবে। চেংনা উচ্চ বিদ্যালয় সেই কাজটি যাচ্ছে নিবির ভাবে।

শিক্ষণ কার্যক্রমের গুরুত্ব

১. জ্ঞানার্জন সহজ করে – শিক্ষণ কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবস্তু বোঝা ও প্রয়োগ করতে সহায়তা করে।
২. মননশীলতা বিকাশ ঘটায় – শুধু মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে বিশ্লেষণ, যুক্তি ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটায়।
৩. নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষা প্রদান করে – শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ ও মানবিকতা তৈরি হয়।
৪. দক্ষতা অর্জনের সুযোগ দেয় – বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ক্রীড়া, সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাস্তব দক্ষতা অর্জন করা যায়।
৫. ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতি নেয় – শিক্ষার্থীরা আত্মনির্ভরশীল, আত্মবিশ্বাসী ও কর্মক্ষম হয়ে ওঠে।

শিক্ষণ কার্যক্রমের ধরন

শিক্ষণ কার্যক্রম সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে—

১. আনুষ্ঠানিক শিক্ষণ কার্যক্রম

এটি হলো শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, পাঠ্যসূচি অনুযায়ী শিক্ষা, নির্দিষ্ট সময় ও পরিবেশে পরিচালিত কার্যক্রম। যেমন: পাঠ্যবই, লেকচার, পরীক্ষামূলক শিক্ষা ইত্যাদি।

২. অনানুষ্ঠানিক শিক্ষণ কার্যক্রম

এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে শ্রেণির বাইরের শিক্ষা। যেমন: আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া, বিজ্ঞান মেলা, লাইব্রেরি ব্যবহার, ভ্রমণ ইত্যাদি।

উভয় কার্যক্রম একে অপরের পরিপূরক এবং শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশে অপরিহার্য।

পড়ায় মনোযোগী হওয়ার উপায়
শিক্ষণ কার্যক্রম

শিক্ষণ কার্যক্রমের ধাপসমূহ

ক. পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন

একজন দক্ষ শিক্ষক প্রথমেই পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করেন। কোন বিষয় কিভাবে উপস্থাপন করা হবে, কোন পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে এবং কত সময় লাগবে তা নির্ধারণ করা হয়।

খ. পাঠদান

পাঠদান হলো শিক্ষণ কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। এর মাধ্যমে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জ্ঞান প্রদান করেন। বর্তমানে শুধুমাত্র বক্তৃতা নয়, বরং ইন্টার‌্যাকটিভ মেথড বা অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে পাঠদান করা হয়।

গ. সহায়ক উপকরণ ব্যবহার

পাঠ্যবিষয়কে সহজ ও আকর্ষণীয় করতে চার্ট, মানচিত্র, প্রজেক্টর, মাল্টিমিডিয়া, ভিডিও, মডেল, ল্যাব সরঞ্জাম ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।

ঘ. অনুশীলন ও কার্যক্রম

শিক্ষার্থীদের দিয়ে অনুশীলন করানো, গ্রুপ ডিসকাশন, প্রজেক্ট ওয়ার্ক, হোমওয়ার্ক, প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শিক্ষণ কার্যক্রমকে কার্যকর করে।

ঙ. মূল্যায়ন ও প্রতিক্রিয়া

শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের মাত্রা যাচাইয়ের জন্য মূল্যায়ন অপরিহার্য। লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা, ব্যবহারিক পরীক্ষা, কুইজ ও অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে এটি সম্পন্ন হয়।

শিক্ষণ কার্যক্রমের বিভিন্ন উপাদান

১. শ্রেণিকক্ষ কার্যক্রম

শ্রেণিকক্ষ শিক্ষার কেন্দ্রস্থল। এখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটে। ব্ল্যাকবোর্ড, মাল্টিমিডিয়া, প্রশ্নোত্তর, লেকচার, গ্রুপ ডিসকাশনের মাধ্যমে পাঠদান পরিচালিত হয়।

২. ল্যাবরেটরি কার্যক্রম

বিজ্ঞান, কম্পিউটার ও গণিত বিষয়ক শিক্ষায় ল্যাবরেটরি কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করে।

৩. লাইব্রেরি কার্যক্রম

লাইব্রেরি শিক্ষণ কার্যক্রমের একটি বড় সহায়ক। এখানে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গল্প, কবিতা, জীবনী, বিজ্ঞানচর্চা, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করে।

৪. ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম

ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ, দলগত কাজ ও নেতৃত্ব শেখায়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।

৫. আইসিটি ও মাল্টিমিডিয়া কার্যক্রম

ডিজিটাল যুগে শিক্ষণ কার্যক্রমে আইসিটির ব্যবহার অপরিহার্য। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস, অনলাইন কনটেন্ট, ই-বুক, ভিডিও কনফারেন্স, প্রোগ্রামিং ও রোবোটিক্স শিক্ষার্থীদের আধুনিক শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করছে।

৬. ভ্রমণ ও শিক্ষাসফর

ভ্রমণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে। ইতিহাস, ভূগোল, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষাসফর অত্যন্ত কার্যকর।


শিক্ষণ কার্যক্রমে শিক্ষকের ভূমিকা

  • পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পাঠদান করা।

  • শিক্ষার্থীর মেধা ও প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষণ পদ্ধতি নির্বাচন করা।

  • শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা।

  • সঠিক মূল্যায়ন ও প্রতিক্রিয়া প্রদান করা।

  • প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করে শিক্ষার্থীদের উপকারে লাগানো।


শিক্ষণ কার্যক্রমে শিক্ষার্থীর ভূমিকা

  • মনোযোগ সহকারে পাঠ গ্রহণ করা।

  • নিয়মিত অনুশীলন ও হোমওয়ার্ক সম্পন্ন করা।

  • গ্রুপ ডিসকাশন ও সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা।

  • শিক্ষকের নির্দেশনা মেনে চলা।

  • সময়ানুবর্তী ও দায়িত্বশীল হওয়া।


শিক্ষণ কার্যক্রমে আধুনিক প্রযুক্তির ভূমিকা

বর্তমানে শিক্ষণ কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। যেমন:

  • মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে পাঠদান।

  • ইন্টারনেটভিত্তিক শিক্ষা।

  • অনলাইন ক্লাস ও ই-লার্নিং।

  • শিক্ষামূলক অ্যাপ ও সফটওয়্যার ব্যবহার।

এসব প্রযুক্তি শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জন সহজ, আকর্ষণীয় ও সময়োপযোগী করছে।


শিক্ষণ কার্যক্রমের সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ

  • অনেক স্থানে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব।

  • পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সংকট।

  • বড় শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাতের অসামঞ্জস্য।

  • মানসম্পন্ন পাঠ্যবই ও উপকরণের স্বল্পতা।

  • দারিদ্র্য ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কারণে অনেক শিক্ষার্থী নিয়মিত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।


সমস্যার সমাধান

১. প্রতিটি বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ।
২. শ্রেণিকক্ষে প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা।
৩. পাঠ্যক্রম আধুনিকায়ন করা।
৪. শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি, সহায়তা ও প্রণোদনা বৃদ্ধি।
৫. অভিভাবক ও সমাজকে শিক্ষণ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা।

শিক্ষণ কার্যক্রম হলো শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাণ। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শুধু জ্ঞানই অর্জন করে না, বরং আত্মবিশ্বাসী, দক্ষ, দায়িত্বশীল এবং সৃজনশীল নাগরিক হয়ে ওঠে। একটি উন্নত জাতি গঠনের জন্য সুষ্ঠু ও আধুনিক শিক্ষণ কার্যক্রম অপরিহার্য।

বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত করতে হলে প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুগোপযোগী শিক্ষণ কার্যক্রম চালু করতে হবে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং রাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রয়াসেই তা সম্ভব।

ধন্যবাদান্তে-
মোঃ আতাউল গনি
সহকারি শিক্ষক
চেংনা উচ্চ বিদ্যালয়
কাপাসিয়া,গাজীপুর

Scroll to Top