চেংনা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইতিহাস
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার এবং সমাজ গঠনের প্রধান ভিত্তি। একটি উন্নত জাতি গঠনের জন্য সুসংগঠিত ও কার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থা অপরিহার্য। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার অন্তর্গত চেংনা গ্রামে ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত চেংনা উচ্চ বিদ্যালয় এমনই একটি অগ্রণী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে জ্ঞানচর্চার আলো ছড়িয়ে আসছে।
প্রতিষ্ঠার পটভূমি
১৯৬০-এর দশকে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) গ্রামীণ অঞ্চলে মাধ্যমিক শিক্ষার প্রচলন খুবই সীমিত ছিল। কাপাসিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম চেংনা ও আশেপাশের এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য তখন নিকটবর্তী কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না। ফলে তারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বঞ্চিত হতো বা দূরবর্তী বিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করতে বাধ্য হতো। এই প্রেক্ষাপটে এলাকার শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ, সমাজসেবক ও অভিভাবকগণ সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেন একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। তাঁদের দূরদর্শিতা ও নিরলস প্রচেষ্টার ফলেই ১৯৬৭ সালে চেংনা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিদ্যালয়ের মৌলিক তথ্য
- প্রতিষ্ঠা সাল: ১৯৬৭ ইং
- বিদ্যালয় কোড: ২১৬৯
- EIIN নম্বর: ১০৯২২৬
- উপজেলা কোড: ১৪১
- জেলা কোড: ১৪
- ডাকঘর: ঘাগটিয়া চালা
- উপজেলা: কাপাসিয়া
- জেলা: গাজীপুর
এই তথ্যগুলো বিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় বহন করে এবং সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রম ও একাডেমিক কার্যাবলীতে বিদ্যালয়ের নিবন্ধন প্রমাণ করে।
প্রথম দিকের শিক্ষা কার্যক্রম
বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে মাত্র কয়েকজন শিক্ষক ও সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান শুরু করা হলেও পরবর্তীতে ধাপে ধাপে নবম ও দশম শ্রেণি চালু করা হয়। বিদ্যালয়ের প্রথম ভবন ছিল টিনের ছাউনি দেওয়া সাধারণ কক্ষ, যা পরে ধীরে ধীরে পাকা ভবনে রূপান্তরিত হয়।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন
শুরুতে ছোট আকারে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে চেংনা উচ্চ বিদ্যালয় একটি সুপ্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০২০/২১ অর্থ বছরে ৪ তলা ভবনে উন্নতি হয়। বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি, আইসিটি ল্যাব এবং খেলার মাঠ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বিদ্যালয়ের প্রতিটি ভবন আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন এবং শিক্ষার্থীদের আরামদায়কভাবে পড়াশোনার সুযোগ দিচ্ছে।
পাঠ্যক্রম ও শিক্ষাদান
বিদ্যালয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠদান করা হয়। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা, কৃষি শিক্ষা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, চারু ও কারুকলা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ অভিজ্ঞ, দক্ষ ও নিষ্ঠাবান। তাঁরা শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠ্যপুস্তকনির্ভর শিক্ষায় সীমাবদ্ধ না রেখে নৈতিকতা, শৃঙ্খলা ও মানবিক গুণাবলির চর্চা করতেও উদ্বুদ্ধ করেন।
সহপাঠ কার্যক্রম
চেংনা উচ্চ বিদ্যালয় শুধু একাডেমিক শিক্ষা দিয়েই থেমে থাকে না, বরং শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এজন্য বিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান মেলা, স্কাউট কার্যক্রম ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। এসব কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বগুণ, আত্মবিশ্বাস, দলগত কাজের দক্ষতা ও সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সহায়ক হয়।
লাইব্রেরি ও পাঠচর্চা
বিদ্যালয়ের একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি রয়েছে, যেখানে পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও বিভিন্ন সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও জ্ঞানবর্ধক বই সংরক্ষিত আছে। শিক্ষার্থীরা অবসর সময়ে লাইব্রেরি ব্যবহার করে নিজেদের জ্ঞান বৃদ্ধি করতে পারে। এই লাইব্রেরি পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
প্রযুক্তি ও আধুনিক শিক্ষা
ডিজিটাল বাংলাদেশের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বিদ্যালয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT) ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার শিক্ষা গ্রহণ করছে এবং আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। এর ফলে তারা ভবিষ্যতের কর্মজীবনে আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠছে।
পরীক্ষার ফলাফল ও অর্জন
চেংনা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন করে। অনেক শিক্ষার্থী মেধা তালিকায় স্থান পায় এবং উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হয়ে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে অবদান রাখছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে।
সমাজে অবদান
বিদ্যালয় শুধু শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করছে—শিক্ষা, প্রশাসন, চিকিৎসা, প্রকৌশল, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতিতে তাঁদের অবদান গর্বের বিষয়। বিদ্যালয়টি স্থানীয় সমাজে শিক্ষার প্রসার, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সংস্কৃতির বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।
এলামনাই কার্যক্রম
চেংনা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা নিয়মিতভাবে বিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। এলামনাই মিটআপ, দান-সহায়তা, বৃত্তি প্রদান, অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগে তাঁরা অংশগ্রহণ করে থাকে। এর ফলে বিদ্যালয়ের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হচ্ছে।
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বিদ্যালয় বর্তমানে একটি আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষ, স্মার্ট বোর্ড, আরও সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ও উন্নতমানের ল্যাবরেটরি স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়ন ও মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে আরও বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ রয়েছে।
পরিশেষে, চেংনা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষা বিস্তার, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং সমাজ গঠনে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। এই বিদ্যালয় শুধুমাত্র একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতীক। শিক্ষা, নৈতিকতা, নেতৃত্ব ও মানবিক গুণাবলির সমন্বয়ে বিদ্যালয়টি এলাকার উন্নয়নে নিরন্তর কাজ করছে।
১৯৬৭ সালে যে প্রতিষ্ঠানটি মাত্র কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, আজ তা গাজীপুর জেলার একটি সুপরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতেও চেংনা উচ্চ বিদ্যালয় তার সুনাম ও ঐতিহ্য ধরে রেখে শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে—এটাই সকলের প্রত্যাশা।